সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে
ব্যাপকভাবে। আর মানুষের এই বদলে যাওয়া জীবনযাপন নিয়ে চলছে নানা রকম গবেষণা।
গত কয়েক বছরে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। এ রকমই কিছু গবেষণার ফলাফল
বিশ্লেষণ করে এবং মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ
করেছে বার্তা সংস্থা আইএএনএস।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাকিত্ব নিয়ে আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে বয়স
হলে মানুষ একা হয়ে যায়। কিন্তু কম বয়সী কিশোর-কিশোরীরাও দিন দিন একা হয়ে
যাচ্ছে ফেসবুকের কারণে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলছে।
ফেসবুকে আসক্তির কারণে কিশোর-কিশোরীরা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে একাকী
জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর এই একাকিত্ব থেকে বাড়ছে হতাশা। দীর্ঘদিনের
হতাশা থেকে তারা হয়ে পড়ছে আত্মহত্যাপ্রবণ।
দিল্লির ফরটিস হেলথ কেয়ার হাসপাতালের মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড
বিহ্যাভিরিয়াল সায়েন্সেসের পরিচালক ডা. সামির পারিখ জানিয়েছেন, ‘একাকিত্ব
শারীরিক ও মানসিক দুদিক দিয়েই রোগীদের ক্ষতি করে। এরা আস্তে আস্তে সবার
থেকে দূরে সরে যায় এবং তাদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।’
একই কথা জানিয়েছেন মুম্বাইয়ের নানাবতি সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের
মনোচিকিৎসক ডা. মাধুরী সিং। তিনি বলেন, ‘সবার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ায়
অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সীদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। এতে আলঝেইমারের ঝুঁকি বেড়ে
যায় এবং আত্মহত্যা বা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।’
আর মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসঙ্গে বসে গল্প
করা বা দেখা করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে আরো বেশি
একাকিত্ব ভর করছে।
নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে নয়াদিল্লির সরোজ সুপার স্পেশালিটি
হসপিটালের কনসালটেন্ট ডা. সন্দীপ গোভিল বলেন, ‘তনয় নামের ১৪ বছর বয়সী এক
ছেলে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ফেসবুকে সে এতটাই আসক্ত ছিল যে ফোন
বন্ধ করে রাখলে সে অস্থির হয়ে পড়ত। আমরা তার এই ‘স্ক্রিন এডিকশন’-এর
চিকিৎসা শুরু করি। তখন ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই আসক্তি থেকে সে আরো বড়
কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারত।’
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-লস
অ্যাঞ্জেলেসের গবেষকরা বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সেখানে
তাঁরা উল্লেখ করেছেন, ‘একাকিত্বের ফলে মস্তিষ্কে বিপজ্জনক সিগন্যাল পৌঁছায়।
যার ফলে হোয়াইট ব্লাড সেলের উৎপাদন ব্যাহত করে। তাই একাকিত্ব থেকে শারীরিক
অসুস্থতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’
ভারতের ম্যাক্স সুপার স্পেশাল হসপিটালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের
পরিচালক ডা. সামির মালহোত্রা বলেন, ‘নিউরোকেমিকেল, হরমোন এবং ইমিউন
সিস্টেমের মাধ্যমে মানুষের মন এবং দেহ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
মানসিকভাবে চাপে থাকলে সেটার প্রভাব মানুষের শরীরের ওপরও পড়ে। মানসিক
অশান্তি থেকে না খাওয়ার কারণেও মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।’
আর এসব কারণেই অনলাইনের বদলে সরাসরি যোগাযোগের দিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
তাঁদের মতে, মুখোমুখি একজন মানুষের সঙ্গে বসে কথা বললে একাকিত্বের কষ্ট
থেকে অনেকাংশেই মুক্তি পাওয়া যায়, মানসিক অশান্তি তৈরির সুযোগ কম থাকে। তখন
মানুষ নতুনভাবে বেঁচে থাকার সাহস পায়। কিন্তু একাকিত্ব ধীরে ধীরে মানুষকে
মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেয়।
আর তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানোর চেয়ে বন্ধুবান্ধব এবং
পছন্দের মানুষদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো, সমস্যার কথা জানানো এবং যোগাযোগ
রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন মনোবিজ্ঞানীরা।