বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ থাকার দরুন ‘বিরুপ প্রভাব’ পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও । সারাবিশ্বে বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীরা নানা কারনে দেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটকে ব্যাবহার করতো । আকস্মিক সরকারী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের উপড় ‘ কড়াকড়ি’ ঘোষনার পর থেকে কার্যত অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ সহ, বিভিন্ন ব্যাবসা বানিজ্যের পথ । এরপরেও ‘ বিকল্প পথে অনেকেই ইন্টারনেটের ব্যাবহার করলেও, সেই সংখ্যা অনেক কম। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর অনেকেই এই বিষয়টিকে সাধুবাদ জানালেও সমালোচনার সংখ্যাটাই মুলত অনেক বেশি ।ঢাকার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অনার্স করছেন নেহা। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে নিজের খরচ বের করতে অনলাইনে বসে ই-কমার্সে গত দুবছর ধরে ব্যবসা শুরু করেছেন। খুব বেশি পুঁজি নেই, ফেসবুকে খোলা একটি পেইজের মাধ্যমেও চলে তার বিভিন্ন পন্যের অর্ডার নেয়া ও ডেলিভারি করার কাজ ।অনেক চেষ্টায় পেইজটিতে লাইক পড়েছে প্রায় তিন লাখ। ডলার খরচ করে পেইজটির বিজ্ঞাপণ চালিয়েছেন দিনের পর দিন। শাড়ি, থ্রি-পিছসহ মেয়েদের অত্যাধুনিক পোশাকের সমাহারও ছিল পেইজটিতে। ছবির সঙ্গে জুড়ে দেয়া দাম। তার নিচে দেয়া মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে অর্ডার দিলে ক্রেতার ঠিকানায় পৌঁছে যেতো পণ্য। পড়াশোনার পাশাপাশি এই ব্যবসা থেকে যা আয় হতো তা দিয়ে দুজন ডেলিভারি ম্যানের খরচসহ নিজের পড়াশোনার খরচটাও বেশ ভালো চলে যেত । কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে দারুন অসহায় সময় কাটছে তার। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে নেহার ভার্চুয়াল স্টোরটিও
নেহার মতো এমন প্রায় কয়েক হাজার তরুন উদ্যোক্তা আছেন যাদের ব্যবসার মূল প্লাটফর্মই হচ্ছে ফেসবুক। নিজের ওয়েবসাইট থাকলেও পণ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য ফেসবুকটাই আসলে মুল মাধ্যম। সেই হিসেবে, ই-কমার্সে মন দিয়েছেন এমন কেউ নেই যে, ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি তাদের।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স একেবারে নতুন না হলেও খুব পুরোনো নয়। তবে ইদানিংকালে ধীরে ধীরে অনলাইন কেনাবেচা জনপ্রিয় হচ্ছে। ঘরে বসে কেনাকাটা যাচ্ছে। সময় বেঁচে যাচ্ছে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রয়োজন সেরে নেয়া যাচ্ছে, আঙুলের ছোঁয়ায়। এটা তো কম কিছু নয়। নগর জীবন, বিশেষ করে ঢাকাবাসীর জন্য উপযোগী অনলাইন কেনাকাটা।
বর্তমানে আন্তঃসীমান্ত ব্যবসা ছাড়াও ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ ফেসবুক নিষেধাজ্ঞা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক গালফ নিউজ বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধের বিরুপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে এ-সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ী সাইফুর রহমানের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ‘আমার ঢাকায় দোকান আছে। কলকাতা থেকে বিভিন্ন পণ্য-সামগ্রী কিনে প্রতি সপ্তাহে সেখানে পাঠাই। তাদের কী প্রয়োজন সেটা জানার জন্য আমি পুরোপুরি হোয়াসঅ্যাপের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞার ফলে আমি অসহায় হয়ে পড়েছি এবং এটা আমার কাজের ক্ষতি করছে।’ অনেকেই বলছেন, তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কলকাতার গৃহবধূ নিরূপা রায় বলেন, ‘ভারতের একটি প্রতিষ্ঠানে আমার স্বীমা কাজ করেন এবং একবার বাংলাদেশে গিয়ে টানা কয়েক সপ্তাহ থাকতে হয়। যোগাযোগের অসুবিধায় আমরা একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছি।’
অন্যদিকে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ গালফ নিউজকে বলেন, ‘সরকার যখন নিরাপদ মনে করবেন তখনই এসব সেবা চালু করা হবে।’
ঢাকার একজন ব্যবসায়ীর উদ্ধৃতি দিয়ে গালফ নিউজ জানায়, ‘আমরা চামড়ার ব্যাগসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করি। এর অর্ডার আসে ফেসবুক পেইজ থেকে। বর্তমানে সেই ব্যাবসায় চরম মন্দা চলছে ’
এ পর্যন্ত ৭ থেকে ৯ টি সামাজিক যোগাযোগের অ্যাপস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেইসবুক, ভাইবার, হোয়াটসএ্যাপ, ট্যাংগো, হ্যাঙ্গআউট, ইউস্টার্ন ডট টিভি, কমিউর, লাইন। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে পক্ষে- বিপক্ষে তীব্র আলোচনা- সমালোচনার যেমন জন্ম দিয়েছে, তেমনি প্রযুক্তিবিদরাও এ সিদ্ধান্তের প্রতি দ্বি-মত পোষণ করেছেন। প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারের যে লক্ষ্য তা পূরণ হবে না এবং কোনো সমাধানও আসবে না। এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে, একদিন না একদিন তো এসব যোগাযোগ মাধ্যম খুলতে হবে। তখন কি হবে? সরকার যে আশঙ্কায় এগুলো বন্ধ করেছে, তা কি নির্মূল হয়ে যাবে? সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠী কি এসব এ্যাপস ব্যবহার বন্ধ করে দেবে?
বিটিআরসি’র হিসাব মতে, দেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে শুধু ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। বাকিরা অন্যান্য মাধ্যম ব্যবহার করছে। এই বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ প্রজন্ম মনে করছে, এটা তাদের অবাধ তথ্য আদান-প্রদান ও মতামত প্রকাশের মতো মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। বিশ্বজুড়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন আইএস তার বেশিরভাগ কার্যক্রম ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে যাচ্ছে। বিশ্বের ক্ষমতাধর ও সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলো তো সেসব যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করতে পারছে না বা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। কারণ, তারা জানে, প্রযুক্তির এ যুগে তা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এক পথ বন্ধ করলে অসংখ্য পথ বের হয়ে যায়। প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন, প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। কোনো এ্যাপস বন্ধ করে নয়।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ নভেম্বর নিরাপত্তার স্বার্থে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার বন্ধ দেয় বাংলাদেশ সরকার। ২১ নভেম্বর রাতে যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ফাঁসি কার্যকর করা হয়।-