স্টেমসেলের সম্ভাবনা ও সঙ্কট।

আমাদের জন্মের পর থেকেই শারীরিক বৃদ্ধির সময়ে স্টেমসেল একাধিক আলাদা আলাদা কোষে পরিণত হয়। স্টেমসেল অসংখ্য কোষে বিভক্ত হয়ে আমাদের শরীরের অনেক টিস্যুর অভ্যন্তরীণ মেরামতের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমাদের মাসলসেল, ব্লাডসেল ও ব্রেনসেলের মতো কার্যক্ষম সেলে পরিণত হতে পারে স্টেমসেল।
আমাদের শরীরে থাকা বা অন্যের থেকে নেয়া একটি বিশেষ কোষ সন্ধান দিতে পারে ব্লাড ক্যান্সার নিরাময়ের। স্টেমসেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এখন সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছতে শুরু করেছে এই সেবা।
জীবনের সুরক্ষার কথা ভেবে যদি বীমা করা হয়, বিভিন্ন রোগ রুখতে যদি আগাম টিকা দিতে হয়, তবে ‘স্টেমসেল’ সংরক্ষণ কেন করবেন না? এই ভাবনা থেকেই কলকাতায় শুরু হয়েছে স্টেমসেল সংরক্ষণ।
স্টেমসেল আসলে শিশু এবং মায়ের নাড়ি যে কর্ডটির মাধ্যমে যুক্ত থাকে, সেটাই। এর নমুনা ও রক্ত সংরক্ষিত থাকলে ভবিষ্যতে সব ধরনের ক্যান্সার, থ্যালাসেমিয়া, বিশেষ ধরনের কিছু অ্যালার্জি ছাড়াও যকৃৎ, বৃক্কসহ রক্তের বিভিন্ন অসুখ সারানো সম্ভব হয়। জন্মের সময় ছাড়া পরে আর কখনো তা পাওয়া যায় না। তাই জিনিসটি সংরক্ষণ করে রেখে দিলে অনেক সুবিধা। বর্তমানে এসব নমুনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে চেন্নাই ও গুরগাঁওয়ের পরীক্ষাগারে। দুর্যোগে, দুর্ঘটনায় বা পরীক্ষাগারে নমুনা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে দুই জায়গায় আলাদা রাখা হচ্ছে। সদ্যোজাত ও মায়ের নাড়ি এবং রক্ত সংরক্ষণ করতে খরচ পড়ে মাত্র ৪০ হাজার টাকা।
স্টেমসেল সাধারণত দু’টি উৎস থেকে উৎপন্ন হয় বিধায় এরা প্রধানত দুই রকমের হয়। ভ্রুণ বিকাশের সময় তৈরি হয় এমব্রায়োনিক স্টেমসেল আর প্রাপ্তবয়স্ক টিস্যুতে তৈরি হয় অ্যাডাল্ট স্টেমসেল। প্রতিটি স্টেমসেল বিভক্ত হয়ে অসংখ্য কোষে পরিণত হতে পারে।
ট্রান্সপ্লান্টেশন
আমাদের শরীরের যেকোনো অংশের টিস্যু ড্যামেজ হলে সেখানে স্টেমসেল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। স্টেমসেল ছোট ছোট গোলাকৃতির হয়। ক্যান্সারের চিকিৎসায় এটি খুব কাজে লাগে। ক্যামোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপি দেয়ার ফলে নিজস্ব স্টেমসেল নষ্ট হয়ে যায় অনেক সময়। ফলে সে জায়গায় নতুন স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে ইনজেকশনের মাধ্যমে স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করা হয়। এসব স্টেমসেল বোনম্যারোর ভেতরে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেয়। বোনম্যারোর ভেতরে ফ্যাটি টিস্যু রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে ধ্বংস হয়ে গেলে স্পেশালাইজড স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করা হয়। আগে এই প্রক্রিয়াকে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন বলা হলেও এখন স্টেমসেল প্রতিস্থাপন হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। কারণ বোনম্যারো টিস্যু নয়, এ ক্ষেত্রে রক্তের স্টেমসেলই প্রতিস্থাপন করা হয়। স্টেমসেল প্রতিস্থাপন মূলত দুই ধরনের। অটোলোগাস ও অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্টেশন।
অটোলোগাস ট্রান্সপ্লান্টেশন
এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে তার নিজস্ব স্টেমসেলই প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর শরীর থেকে স্টেমসেল সংগ্রহ করে স্পেশাল ফ্রিজে রাখা হয়। বছরের পর বছর এসব স্টেমসেল সংরক্ষণ করা যায়। রেডিয়েশন থেরাপির পরে ফ্রোজেন স্টেমসেল রোগীর শিরায় প্রতিস্থাপন করা হয়।
প্রাপ্তবয়স্ক কোষকে বিভিন্ন অঙ্গে ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তোলার পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য ২০১২ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন স্টেমসেল গবেষক ব্রিটেনের স্যার জন গার্ডন ও জাপানের শিনিয়া ইয়ামানাকা। তাদের এ গবেষণার উদ্দেশ্যে হচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্ক কোষ থেকে এসব স্টেমসেল তৈরি করা, যারা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশেও কাজ করতে সক্ষম হবে।
পিছু ছাড়ছে না বিতর্ক
স্টেমসেল এই নামটি ইদানীং আমরা প্রায়ই শুনছি। মানুষের ভ্রুণের মধ্যে অবস্থিত স্টেমসেল নিয়ে চলছে নানা ধরনের গবেষণা। স্টেমসেল থেকে অনেক রকমের সেল বা কোষ পাওয়া যায়। মাতৃজঠরে যখন ভ্রুণের উৎপত্তি শুরু হয় প্রথম দিকে, কিন্তু সেল বা কোষগুলো একই রকম থাকে। এরপর এক পর্যায়ে কোনো সেল লিভারের কোষে পরিণত হয় যা থেকে মানুষের লিভার হয়, কোনো সেল কিডনি সেল, মস্তিষ্কের কোষ এবং চোখের কোষ তৈরি হয়। স্টেমসেলের এমন সম্ভাবনা আছে যে, এ ধরনের কোষ থেকে বিভিন্ন ধরনের কোষ আমরা পেতে পারি।
কারো ডায়াবেটিস হলে, তার যদি টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস হয় তাহলে বেটাসেলগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। তার মধ্যে যদি স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করা হয় এবং সেই স্টেমসেলগুলো তার মধ্যে বেটাসেল তৈরি করে তাহলে তার ডায়াবেটিস সেরে যেতে পারে। কারো যদি মস্তিষ্কের অসুখ হয়ে থাকে, মস্তিষ্কের কোনো কোষ নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা মারা গেছে তাহলে এই কোষগুলোকেও পুনরায় জাগিয়ে তোলা যেতে পারে যদি ঠিকমতো তার মধ্যে স্টেমসেলগুলো প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। আর এ কারণেই স্টেমসেলের গবেষণার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
ভবিষ্যতে অনেক রোগের প্রতিষেধক ওষুধ হয়তো এ গবেষণার মাধ্যমে আসতে পারে। যেহেতু এই সেলগুলো আমরা ভ্রুণ থেকে পেয়ে থাকি, তাই এই সেলগুলোর ওপর গবেষণা চালানোর মানে হচ্ছে, মানবশিশুরা এ সেলগুলো থেকে হতে পারতো তা আমরা হতে দিচ্ছি না। এটাকে এক ধরনের হত্যাও বলা হচ্ছে। অনেকে বলছে এমন কোনো অধিকার আমাদের নেই। এ জন্যই বিতর্ক হচ্ছে।
স্টেমসেলের গবেষণার এসব বিষয় নিয়ে গোটা বিশ্বেই এখন চলছে নানা বিতর্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বিতর্ক সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীরা এই গবেষণার পক্ষে অবস্থান নিলেও সেখানকার ধর্মীয় নেতারা এ গবেষণার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার সহায়তা দিয়ে থাকলেও সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ স্টেমসেল নিয়ে গবেষণার ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেন। বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এত দিন ধরে এ বিধিনিষেধ অব্যাহত ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের পর পরিস্থিতি পাল্টেছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি এ ধরনের গবেষণা কর্মের ওপর বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছেন। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য নিজেরা আইন করে এ গবেষণাকর্ম নিষিদ্ধ করেছে। অবাক বিষয় হলো এর পরেও চলছে গবেষণা।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট